সংবাদ শিরোনামটি “অরক্ষিত ড্রেন, দুর্ঘটনার শঙ্কা”। গত মঙ্গলবার দৈনিক সুনামকণ্ঠে এই শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদবিবরণের শুরুতেই বলা হয়েছে, “সুনামগঞ্জ শহরের পৌর মার্কেট ও শহীদ মিনার এলাকায় ড্রেন থাকলেও, তাতে স্ল্যাব নেই। অরক্ষিত এই ড্রেনের পাশ দিয়ে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন পথচারীরা। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সচেতন নাগরিকবৃন্দ জনগুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় নির্মিত ড্রেনের ওপর দ্রুত স্ল্যাব স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।”
জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এমন বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হওয়ার কারণ কী? এটা একটা প্রশ্ন বটে। তারপর এমন মন্তব্য করাও একেবারে অসঙ্গত হবে না যে, এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে রাজধানীসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সকল শহরের রাস্তাই উন্নত যে-কোনও দেশের তুলনায় যারপরনাই সংকীর্ণ। এই কারণে আমাদের শহরকে উন্নত শহর বলার কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি নেই। শহরের রাস্তার প্রশস্ততা প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘যান ও জন চলাচল’-এর জন্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে কতোটা হওয়ার দরকার তার একটা আদর্শ বা মান মাপ আছে। অর্থাৎ বোধ করি পৌরসভার বাসাবাড়ি করা ও বাসাবাড়ির সঙ্গে যান-জন চলাচলের প্রশস্ত রাস্তা রাখার নিয়ম আছে। কিন্তু প্রশাসনিক প্রভুত্বের সঙ্গে প্রশাসনে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের নীতিবহির্ভূত অবৈধ ও অন্যায় সমঝোতার অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিজ্ঞানসম্মত নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে উঠে না মোটেও। এই অনৈতিক প্রকরণের বশীভূত হয়ে অবকাঠামো বিনির্মাণে মান বজায় রাখতে বা সেটা কার্যকর করতে আমরা জাতিগতভাবে অপারগ। আমরা ব্যক্তিমালিকনায় জমি বাড়ানোর লোভে এতোটাই অন্ধ যে, পাড়ার অভ্যন্তরে দমকল যাতায়াত করতে পারে এমন প্রশস্ত রাস্তা রেখে বাসা বানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না, সংলগ্ন পুকুরগুলোকেও দখল করে ফেলি এবং ড্রেন নির্মাণের জায়গা থাকে না।
বিশিষ্ট নাগরিকের বাড়ির সামনে এসে ড্রেন নির্মাণ রহস্যজনক কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া মহল্লা বা পাড়ার ভেতরে অগ্নি নির্বাপণের সব রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে সেটা ভুলে যাই।
কাকে দোষ দেই? দোষটা তো আমাদেরই। আসলে আমরা জাতিগতভাবে পৌরনাগরিক হওয়ার উপযুক্ত নই। এবংবিধ বিবেচনায় সুনামগঞ্জ কোনও ব্যতিক্রমী শহর নয়। এখানে অবকাঠামো বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বিভ্রাট লেগেই থাকবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যেমন পৌরবিপণির সামনের রাস্তায় ড্রেনসংস্কার কাজে বিতিকিচ্ছিরি বিভ্রাট লেগে রয়েছে বহুদিন ধরে।
অভিজ্ঞমহল মনে করেন যে, প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদা কাগজে কলমে বহাল রাখতেই পছন্দ করেন এই পৌরসভার নাগরিকেরা এবং প্রকারান্তরে তাঁরা বাস করতে চান নি¤œ শ্রেণির পৌরশহরে। আমাদের জনবান্ধব পৌরকর্তৃপক্ষ রাস্তা করে দিয়েছেন জনচলাচলের জন্যে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় রাস্তার দুপাশের দোকানমালিকেরা এই রাস্তার ফুটপাতটাকে দখল করে নেন। এমনিতেই আদর্শ মাপ থেকে ছোট রাস্তা আরও ছোট হয়ে পড়ে এবং জনজট ও যানজটের অবসান ঘটে না। পথচারীরা সাধারণত এই দখলের বিরুদ্ধে কীছু বলেন না বা প্রতিবাদমুখর হন না। এমনকি পৌর কর্তৃপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলররা এই দখলের বিরুদ্ধে কীছু করেন না। তারা কেন নীরব থাকেন সাধারণ পৌর নাগরিকেরা তা জানেন না বা জেনেও চুপ করে থাকেন। তাছাড়া আছে আরও কীছু ঝুটঝামেলা। যেমন ড্র্রেন নির্মাণে প্রযুক্তিবিজ্ঞানবিধি অনুসরণ না করা। যা শেষ পর্যন্ত পৌরনাগরিকদের জন্য দুর্ভোগর কারণ হয়। কেউ কেউ মনে করেন : ড্রেন সংস্কারের কাজে স্ল্যাব তোলা, ড্রেন পরিষ্কার করা ও সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণের কাজে সময়ের কোনও ফাঁক না দিয়ে ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা করে শেষ করা হলেই ‘অরক্ষিত ড্রেন, দুর্ঘটনার শঙ্কা’জনক অবস্থা তৈরি হয় না। কর্তৃপক্ষ সেটা কেন করেন না সেটা বোধগম্য নয়। নাকি এইসব কাজের ক্ষেত্রে সময়ের বড় ব্যবধান না রেখে ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা করে শেষ করা কোনও অবস্থাতেই সম্ভব হয়ে উঠে না। যদি সম্ভব হয় তবে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কেন সে-রকমভাবে কাজের সূচি সাজিয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয় না? এমনতর প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রকৃতপ্রস্তাবে সত্য এই যে, আমাদের দেশে শহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কখনওই আদর্শ মাপ অনুসরণ করা হয় না। সুনামগঞ্জ তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে প্রতিটি রাস্তা সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণ রাস্তার ফুটপাতগুলো কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় অধিকার হয়ে যায়। এটা আমদের জাতিগত সংকীর্ণতার একটি লক্ষণ। এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিশেষে এই আশা করছি যে, যতোটা সম্ভব দ্রুত পৌরবিপণির ও শহীদ মিনার এলাকার ড্রেনের সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে জনভোগান্তি দূর করা হবে।